প্রযুক্তি যত উন্নত হয়েছে ইলেকট্রনিক ডিভাইস ততই তারহীন হয়ে গেছে। ব্লুটুথ নামক এই প্রযুক্তি সেই তারবিহীন মাধ্যম গুলোর মধ্যে অন্যতম। আমরা আমাদের প্রতিদিনের জীবনে এমন অনেক ডিভাইস ব্যবহার করছি, যেখানে ব্লুটুথের ভূমিকা অপরিসীম।
যেমন, কম্পিউটারে মাউস ছাড়াই কাজ করা যায় না আর এটাও এখন তারবিহীন বা গান উপভোগ করার জন্য হেডফোন তাও তারবিহীন। এই আর্টিকেলে, ব্লুটুথ কি? ব্লুটুথের ইতিহাস, এর ব্যবহার, সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
পোস্টের বিষয়বস্তু
ব্লুটুথ কি
ব্লুটুথ হলো একটি বেতার প্রযুক্তি, যেটি কম শক্তি ব্যবহার করে অল্প দূরত্বের মধ্যে ডিভাইসের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান করে। এই প্রযুক্তি মূলত মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, হেডফোন, কিবোর্ড, মাউস, স্মার্টওয়াচ, স্পিকার ইত্যাদির মধ্যে সংযোগ স্থাপন করার জন্য ব্যবহৃত হয়। ব্লুটুথের মাধ্যমে আমরা তার ছাড়াই এইসব ডিভাইসের মধ্যে ডেটা ট্রান্সফার করতে পারি।
ব্লুটুথ এর ইতিহাস
ব্লুটুথ প্রযুক্তি প্রথমবারের মতো ১৯৯৪ সালে সুইডিশ কোম্পানি Ericsson এর এক প্রকৌশলী জ্যাপ হার্টসন দ্বারা তৈরি করা হয়। ১৯৯৯ সালে এই প্রযুক্তির উন্নয়নে ব্লুটুথ স্পেশাল ইন্টারেস্ট গ্রুপ গঠিত হয়। এই সংস্থায় সোনি এরিকসন, নোকিয়া, তোশিবা, আইবিএম এবং ইন্টেলের মতো বড় প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করেছিল।
এর নামকরণ করা হয় ১০ম শতাব্দীর ডেনমার্কের রাজা হারাল্ড ব্লুটুথ এর নামে, যিনি ডেনমার্ক এবং নরওয়ের মধ্যকার বিভিন্ন অংশ একত্রিত করেছিলেন। এই নামকরণ ব্লুটুথ প্রযুক্তির কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত, কারণ এটি ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলোর মধ্যে তারহীন সংযোগ তৈরি করে।
ব্লুটুথ এর ব্যবহার
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্লুটুথ ব্যাপক ভুমিকা পালন করে। আমরা হরহামেশাই ব্লুটুথ ডিভাইস ব্যবহার করি। তবে উল্লেখ্যযোগ্য কিছু ব্যবহার রয়েছে ব্লুটুথ এর, সেগুলো হলো:
- ব্লুটুথের মাধ্যমে মোবাইল ফোন এবং কম্পিউটারের মধ্যে ফাইল, ছবি, ভিডিও, মিউজিকসহ বিভিন্ন ধরনের ডেটা আদান-প্রদান করা সম্ভব।
- ব্লুটুথের অন্যতম প্রধান ব্যবহার হলো তারবিহীন হেডফোন ও স্পিকারের সাথে সংযোগ। গান শোনা, মুভি দেখা বা ফোনে কথা বলার সময় তারের ঝামেলা ছাড়াই আরামদায়কভাবে ব্যবহার করা যায়।
- অনেক আধুনিক গাড়িতে ব্লুটুথ সংযোগের সুবিধা রয়েছে, যার মাধ্যমে ফোন কল করা, মিউজিক শোনা বা গাড়ির অন্যান্য ফিচার নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ড্রাইভিং এর সময় হাত না লাগিয়ে ফোন কল করার ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত সহায়ক।
- ব্লুটুথের মাধ্যমে ওয়্যারলেস কিবোর্ড এবং মাউস ব্যবহার করা খুব সহজ। এর ফলে তারের ঝামেলা ছাড়াই ডেস্কটপ বা ল্যাপটপের সাথে এগুলো ব্যবহার করা যায়।
- ফিটনেস ট্র্যাকার বা স্মার্টওয়াচের মতো ডিভাইস ব্লুটুথের মাধ্যমে মোবাইল ফোনের সাথে সংযুক্ত থাকে। এর মাধ্যমে ফোনে থাকা বিভিন্ন নোটিফিকেশন, কল, মেসেজ ইত্যাদি দেখা যায় এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য ট্র্যাক করা যায়।
- ব্লুটুথের মাধ্যমে মোবাইল ডেটা শেয়ারিংও সম্ভব। ব্লুটুথ হটস্পট ব্যবহার করে মোবাইল ডেটা অন্যান্য ডিভাইসের সাথে শেয়ার করা যায়।
- ব্লুটুথ সাপোর্ট করে এমন প্রিন্টারের মাধ্যমে মোবাইল বা কম্পিউটার থেকে ডকুমেন্ট প্রিন্ট করা যায়। এতে করে USB কেবল ছাড়াই সহজে কাজ সম্পন্ন করা যায়।
ব্লুটুথ এর বৈশিষ্ট্য
যেকোনো জিনিস চেনা ও বুঝার জন্য তার বৈশিষ্ট্য গুলো দেখে নিতে হয়। এই পর্যায়ে উল্লেখ্যযোগ্য কিছু বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানবো:
- স্বল্প দূরত্বে সংযোগ এর জন্য ব্যবহার করা হয়
- লো পাওয়ার কনজাম্পশন (কম শক্তি ব্যবহার হয়)
- অটোমেটিক সংযোগ এবং পুনঃসংযোগ হয়ে থাকে
- সুরক্ষিত ডেটা ট্রান্সফার সিস্টেম
- একাধিক ডিভাইসের সাথে সংযোগ করা যায়
- সহজ ব্যবহার এবং ইনস্টলেশন
- কম খরচের প্রযুক্তি
- ইন্টারফারেন্স-মুক্ত সংযোগ
- বিশ্বব্যাপী সাপোর্টেড স্ট্যান্ডার্ড
- ইনফ্রারেডের বিকল্প
ব্লুটুথ এর সুবিধা ও অসুবিধা
বিষয় | সুবিধা | অসুবিধা |
স্বল্প দূরত্বে যোগাযোগ | কম দূরত্বে কার্যকর সংযোগ স্থাপন করে, যেমন ১০ থেকে ১০০ মিটার পর্যন্ত। | বড় দূরত্বে কাজ করতে অক্ষম, যা Wi-Fi বা অন্যান্য প্রযুক্তির তুলনায় সীমিত। |
শক্তি সাশ্রয়ী | কম শক্তি ব্যবহার করে, ফলে ব্যাটারি চালিত ডিভাইস দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবহার করা যায়। | দূরত্ব বাড়লে শক্তি খরচ বেড়ে যায়, এবং ডেটা স্থানান্তরের গতি কমে যায়। |
সহজ সংযোগ | ব্যবহার সহজ এবং automatic ভাবে ডিভাইসগুলোর পুনঃসংযোগ করতে পারে। | প্রথমবার সংযোগ করতে একটু সময় লাগে এবং মাঝে মাঝে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। |
সাশ্রয়ী খরচ | অন্যান্য বেতার প্রযুক্তির তুলনায় কম খরচে ডিভাইসের মধ্যে ডেটা স্থানান্তর করা যায়। | বড় পরিসরে ব্যবহারের জন্য এটি ব্যয়বহুল হবে, বিশেষত বৃহৎ ডেটা ট্রান্সফারের জন্য। |
নিরাপদ ডেটা আদান-প্রদান | এনক্রিপশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে, ফলে ডেটা স্থানান্তর নিরাপদ থাকে। | যদিও সুরক্ষিত, তবুও এটি উচ্চমাত্রার নিরাপত্তা প্রযুক্তি নয়, এবং উন্নত হ্যাকারদের দ্বারা হ্যাক করা সম্ভব। |
ইন্টারফারেন্স-মুক্ত | বিভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে ইন্টারফারেন্স-মুক্ত সংযোগ দেয়। | কাছাকাছি অনেক ব্লুটুথ ডিভাইস থাকলে ইন্টারফারেন্স হতে পারে। |
একাধিক ডিভাইস সংযোগ | একাধিক ডিভাইসের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারে, যেমন ফোন, হেডফোন, স্মার্টওয়াচ ইত্যাদি। | একসাথে খুব বেশি ডিভাইস সংযোগ করলে কার্যক্ষমতা কমে যায় |
ইনফ্রারেডের বিকল্প | সরাসরি লাইন-অফ-সাইট প্রয়োজন হয় না, ফলে ডিভাইসগুলো ভিন্ন অবস্থানে থাকলেও সংযোগ করা যায়। | অন্য রুম বা দেয়াল থাকা অবস্থায় সংযোগের কার্যকারিতা হ্রাস পায়। |
ব্লুটুথ কিভাবে কাজ করে
ব্লুটুথ একটি স্বল্প দূরত্বের বেতার যোগাযোগ প্রযুক্তি, যা ডিভাইসগুলোর মধ্যে ডেটা আদান-প্রদান করতে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে। ব্লুটুথের কাজ করার মূল প্রক্রিয়া নিচে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো:
ব্লুটুথ যোগাযোগের জন্য ২.৪৫ গিগাহার্টজ (GHz) ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে। এটি একটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল, সায়েন্টিফিক এবং মেডিকেল (ISM) ব্যান্ড। এই ব্যান্ডটি বিশ্বব্যাপী উন্মুক্ত ও ব্যবহারযোগ্য, যার ফলে ব্লুটুথ প্রযুক্তি যেকোনো ডিভাইসের মধ্যে ব্যবহার করা যায়।
মূলত ব্লুটুথ ডিভাইস দুটি সংযুক্ত হওয়ার জন্য প্রথমে “পেয়ারিং” প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। প্রক্রিয়াটি হলো: পেয়ারিং মোড চালু করা > ডিভাইস সনাক্তকরণ > কানেক্টেড করা।
ব্লুটুথের মাধ্যমে ডিভাইস গুলোর মধ্যে একটি ছোট নেটওয়ার্ক তৈরি হয়, যা পিকোনেট নামে পরিচিত। এক পিকোনেটে একটি মাস্টার ডিভাইস এবং সর্বোচ্চ সাতটি স্লেভ ডিভাইস থাকতে পারে। মাস্টার ডিভাইস সংযোগটি নিয়ন্ত্রণ করে এবং অন্যান্য স্লেভ ডিভাইসের সাথে যোগাযোগ করে।
এরপর রেডিও তরঙ্গ ব্যবহার করে ডিভাইসগুলোর মধ্যে ডেটা আদান-প্রদান করে। এতে দুটি ধরণের পদ্ধতি রয়েছে। ১) এসিনক্রোনাস সংযোগ-অরিয়েন্টেড; ২) সিনক্রোনাস সংযোগ অরিয়েন্টেড
ফ্রিকোয়েন্সির ক্ষেত্রে ব্লুটুথ একটি বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সি হপিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে, যেখানে এটি প্রতি সেকেন্ডে ১৬০০ বার ফ্রিকোয়েন্সি পরিবর্তন করে। এই পদ্ধতিটি ইন্টারফারেন্স কমিয়ে ডিভাইস গুলোর মধ্যে নির্ভরযোগ্য যোগাযোগ বজায় রাখে।
সবশেষে, ব্লুটুথের মাধ্যমে ডেটা আদান-প্রদান সুরক্ষিত রাখতে বিভিন্ন ধরণের এনক্রিপশন ব্যবহার করা হয়। পেয়ারিং প্রক্রিয়াতে পিন বা কোড ব্যবহার করে ডিভাইসের মধ্যে সুরক্ষিত সংযোগ স্থাপন করা হয়, যা ডেটা চুরি বা হ্যাকিং থেকে রক্ষা করে। এবং এভাবেই শুরু থেকে শেষ অব্দি ব্লুটুথের কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
আরো পড়ুন
ব্লুটুথ সম্পর্কে আমাদের মতামত
পুরো আর্টিকেল জুরে আমরা জানিয়েছি Bluetooth সম্পর্কে যেখানে ব্লুটুথ কি, এর ইতিহাস, সুবিধা অসুবিধাসহ ব্লুটুথ কিভাবে কাজ করে সেই প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করেছি। এরকম নিত্যনতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে আরো তথ্যবহুল আর্টিকেল পাওয়ার জন্য আমাদের ওয়েবসাইটের সাথে থাকুন। এবং ব্লুটুথ সম্পর্কে যদি আপনাদের কোন প্রশ্ন থেকে থাকে তাহলে অবশ্যই আমাদের কমেন্টের মাধ্যমে জানান। সম্পূর্ণ আর্টিকেল জুড়ে আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।