দেশের অর্থনীতির বৃহত্তর স্বার্থের কথা চিন্তা করে সরকার দেশে বিশেষায়িত ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে থাকে। এই ব্যাংকগুলো দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু এরা শুধুমাত্র মুনাফা অর্জনের জন্যই ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। সহজ কথায় বলতে গেলে, যে ব্যাংকগুলো নির্দিষ্ট ধরনের গ্রাহক বা শিল্পের জন্য আর্থিক সেবা প্রদানের প্রতি মনোনিবেশ করে তাকেই বিশেষায়িত ব্যাংক বলা হয়ে থাকে। এদের নিয়ম নীতি সাধারণ বাণিজ্যিক ব্যাংকের তুলনায় কিছুটা ভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের সরকারের মালিকানাধীন তিনটি বিশেষায়িত ব্যাংক রয়েছে যা সম্পূর্ণরূপে সরকারের হস্তক্ষেপে পরিচালিত হয় এবং নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য পূরণের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নির্দিষ্ট গ্রাহক গোষ্ঠীর কাজ করে থাকে বলে এদেরকে বিশেষায়িত ব্যাংক বলা হয়ে থাকে। আজকের আর্টিকেলে আমরা বিশেষায়িত ব্যাংক কাকে বলে? বিশেষায়িত ব্যাংক কয়টি ও কি কি সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
পোস্টের বিষয়বস্তু
বিশেষায়িত ব্যাংক কি
যখন কোন ব্যাংক নির্দিষ্ট ধরনের গ্রাহক বা শিল্পের উদ্দেশ্যে আর্থিক সেবা প্রদানের জন্য ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে তাকে বিশেষায়িত ব্যাংক বলা হয়ে থাকে। বিশেষায়িত ব্যাংকের নিয়ম নীতি বাণিজ্যিক ব্যাংকের নিয়ম নীতি থেকে কিছুটা ভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষের চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যে এরা যে নিয়ম নীতি এবং উদ্দেশ্য অনুসরণ করে তা অন্যান্য ব্যাংক থেকে আলাদা।
বাংলাদেশের বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক অন্যতম। শুধুমাত্র কৃষি ক্ষেত্রে উন্নয়নের লক্ষ্যে এবং কৃষকদের স্বল্প সুদের ঋণ প্রদানের জন্য বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। এমন প্রত্যেকটি বিশেষায়িত ব্যাংকের আলাদা আলাদা উদ্দেশ্য রয়েছে এবং তাদের গ্রাহকের সংখ্যাও নির্দিষ্ট। মূলত দেশের বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে সরকার বিশেষায়িত ব্যাংক প্রতিষ্ঠা অনুমতি প্রদান করে থাকে।
বিশেষায়িত ব্যাংকের কাজ কি
বিশেষ কোন উদ্দেশ্য প্রদানের জন্য যেহেতু বিশেষায়িত ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয় সেহেতু এর ব্যাংকিং কার্যক্রম কিছুটা ভিন্ন ধরনের হবে এটাই স্বাভাবিক। চলুন এক নজরে বিশেষায়িত ব্যাংকের কাজ কি তা দেখে আসা যাক।
- বিভিন্ন ছোট, বড়, মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ প্রদান, পুঁজি গঠন, তারল্য নীতি প্রণয়ন এবং ভবিষ্যত লক্ষ্য নির্ধারণ করে থাকে।
- স্থির পরিকল্পনা গ্রহণ, মান নির্ধারণ এবং আর্থিক নীতি প্রণয়ন এ ব্যাংকের অন্যতম উদ্দেশ্য।
- আর্থিক ব্যবস্থাপনার প্রতি উত্তম মাত্রায় দায়িত্বশীল থাকা,
- হিসাবধারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে বেতন-ভাতা ও পারিশ্রমিক তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ করা।
- হিসাব ধারী প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর Cash Control কার্যক্রম চালিয়ে দায় এবং ঋণ এর হিসাব রাখা।
- কোন নির্দিষ্ট খাত বা শিল্পকে বিবেচনা করে ঋণ প্রদান করা।
বিশেষায়িত ব্যাংক কয়টি
বাংলাদেশে (Specialized Bank) বা বিশেষায়িত ব্যাংকের সংখ্যা হল তিনটি। যথা:
- বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক,
- প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক,
- রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক,
নিচে এই তিনটি ব্যাংক সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য আলোচনা করা হলো।
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক কে সংক্ষেপে বি কে বি বলা হয়। এটি একটি শতভাগ সরকারি মালিকানাধীন বিশেষায়িত ব্যাংক। কৃষি ব্যাংকের অধ্যাদেশ President’s Order No 27 of 1973 এর মাধ্যমে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা এবং খাদ্যদ্রব্যের উপর স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এই ব্যাংকের প্রধান উদ্দেশ্য। কৃষি ক্ষেত্রে দারিদ্র বিমোচন, এসএমই ও কৃষিভিত্তিক শিল্পে ঋণ প্রদান এবং মানুষের দৌড়গোড়ায় ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেওয়া বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের উদ্দেশ্য।
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের দায়িত্বে রয়েছে ১১ সদস্য বিশিষ্ট একটি পরিচালনা পর্ষদ। এবং এই ব্যাংকের প্রধান ব্যক্তিত্বের দায়িত্ব আছেন মো: নাসিরুজ্জামান (চেয়ারম্যান), মো:শওকত আলী খান (ব্যবস্থাপনা পরিচালক)। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের প্রধান কার্যাবলী গুলো হল:
- রেমিটেন্স সময় মত পরিবারের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া,
- মুক্তিযোদ্ধা ভাতা,বয়স্কভাতা,বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা দুস্থ মহিলা দের সামাজিক কর্মসূচির আওতায় আনা,
- সরকারি সঞ্চয়পত্র বিক্রয় ও প্রাইজবন্ড ক্রয়বিক্রয়ড়
- চলতি,সঞ্চয়ী,এসএনডি ও মেয়াদীসহ সঞ্জয় প্রকল্প বাস্তবায়ন,
- শিল্প ভিত্তিক বিভিন্ন শিল্প সম্প্রসারণ এবং অগ্রাধিকীকরণ,
- চলমান ঋণ এবং এসএমই খাতে ঋণ বিতরণ করাও এই ব্যাংকের প্রধান উদ্দেশ্য।
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক
প্রবাসীদের জন্য প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক অন্যতম। এটি একটি বিশেষায়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠান যা ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ২০১০ সালে ব্যাংকটি যখন প্রতিষ্ঠা করা হয় তখন এর মূল লক্ষ্য ছিল প্রবাসী বাংলাদেশীদের আর্থিক সেবা প্রদান করা। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক যখন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল তখন এর মূলধনের পরিমাণ ছিল ১ বিলিয়ন টাকা। এবং এই প্রায় সম্পূর্ণ অর্থ প্রবাসী কল্যাণ ফান্ড থেকে সরবরাহ করা হয়েছে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালের ২০ শে এপ্রিল এই ব্যাংকের শুভ উদ্বোধন করেন।
বর্তমানে এ ব্যাংকের প্রধান ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিয়োজিত আছেন মোঃ মজিবর রহমান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক এর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো ব্যাংকটি এ পর্যন্ত প্রায় ৮৫ হাজার বিদেশগামী কর্মীকে অধিবাসী ঋণ প্রদান করেছে। বিদেশগামী কর্মীদের জন্য মাত্র তিন দিনে অভিবাসন ঋণ প্রদান করে থাকে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল এখানে যারা অভিবাসন ঋণের জন্য আবেদন করেন তাদের বাড়িতে সশরীরে উপস্থিত হয়ে ব্যাংক কর্মীগণ টাকা এবং যাবতীয় কাগজপত্র পৌঁছে দেন। বর্তমানে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের শাখার সংখ্যা ১০১ টি। এবং কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশের ৬৪ টি জেলায় ব্যাংকটির শাখা খোলার পরিকল্পনা রয়েছে।
রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক
দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সর্ববৃহৎ উন্নয়ন অংশীদার এবং কিসের ঋণ সরবরাহকারী বৃহত্তম আর্থিক প্রতিষ্ঠান হল প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক। ১৯৮৬ সালে প্রতিটি বিভাগে একটি করে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশে প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৬ এর রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ নং ৫৮) মাধ্যমে ১৯৮৭ সালের ১৫ মার্চ প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক পরিচালনার জন্য পরিচালনা পর্ষদের দায়িত্ব রয়েছেন ১১ সদস্য বিশিষ্ট একটি পরিচালনা পর্ষদ।
বর্তমানে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক এর চেয়ারম্যান হলেন ষ্মোঃ রইছউল আলম মন্ডল এবং মো: আব্দুল মান্নান (ব্যবস্থাপনা পরিচালক)। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের সদর দপ্তর ২৭২, বনলতা বাণিজ্যিক এলাকা, রাজশাহী, বাংলাদেশ এ অবস্থিত।
বাংলাদেশে বিশেষায়িত ব্যাংকের গুরুত্ব
বিশেষায়িত ব্যাংকের অন্য নাম হলো উন্নয়ন ব্যাংক। নির্দিষ্ট কয়েকটি সেক্টরে মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদান করা এ ব্যাংকের মূল উদ্দেশ্য। বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। নিচে বাংলাদেশে বিশেষায়িত ব্যাংকের গুরুত্ব তুলে ধরা হলো:
অর্থনৈতিক পুনর্গঠন
মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার যে মন্দা চলছিল সে অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বিশেষায়িত ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। মানুষকে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলার জন্য ব্যক্তিগত পর্যায়ে থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছিল। বিশেষায়িত ব্যাংক কর্তৃক ব্যক্তিগত পর্যায়ে ক্ষুদ্র, মাঝারি এবং বৃহত্তর ঋণ প্রদানের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে সুদৃঢ় করা হয়।
কুটির শিল্প ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ের জন্য অর্থসংস্থান
ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের চাহিদা এ দেশে কখনোই কমেনি। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের জন্য যে পরিমাণ অর্থায়নের প্রয়োজন তা ব্যক্তিগত পর্যায়ে থেকে সংগ্রহ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। যেহেতু ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের জন্য ঋণ সরবরাহ করা
বেষ্টিক ও সামষ্টিক পরিকল্পনার মধ্যে সমন্বয় সাধন
দেশের বড় বড় ব্যবসা সাধারণত ব্যক্তিগত পর্যায়ে থেকেই শুরু হয়। ব্যবসায়ের আজকের একটি ক্ষুদ্র পরিকল্পনা পরবর্তীতে পরিবার, সমাজ এমনকি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রভাব ফেলে। বিশেষায়িত ব্যাংক বিশেষ উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ঋণ সরবরাহ করে থাকে। পরবর্তীতে সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রভাব বিস্তারের জন্য এই বিশেষায়িত ব্যাংক সবচেয়ে মুখ্য ভূমিকা রাখে বলে দেখা যায়।
মূলধন সংগঠন
বাংলাদেশের মূলধন গঠন এবং সঞ্চয় হার তুলনামূলক বেশ কম। এখানে আশানুরূপ বিনিয়োগ এবং সঞ্চয় কখনোই প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। সঞ্চয় এবং বিনিয়োগের ব্যবধান কাটিয়ে ওঠা বাণিজ্যিক ব্যাংকের একার পক্ষে সম্ভব নয়। তাইতো এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকের পাশাপাশি মূলধন সংগঠনের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বিশেষায়িত ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়।
FAQ
১)সবচেয়ে নিরাপদ ব্যাংক কোনটি?
উঃ বাংলাদেশের সরকারি তালিকাভুক্ত যে কোন ব্যাংকই নিরাপদ।
২)দেশের বৃহত্তম বিশেষায়িত ব্যাংক কোনটি?
উঃ দেশের বৃহত্তম বিশেষায়িত ব্যাংক হল বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক।
৩)বাংলাদেশের দুটি বিশেষায়িত ব্যাংকের নাম কি?
উঃ বাংলাদেশের দুইটি বিশেষত্ব ব্যাংকের নাম হলো বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক এবং প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক।
আরো পড়ুন
বিশেষায়িত ব্যাংক সম্পর্কে আমাদের মতামত
দেশের বৃহত্তর কল্যাণের লক্ষ্যে বিশেষায়িত ব্যাংক গুলো প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। দেশের বৃহত্তম তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলো বিশেষায়িত ব্যাংকের উপর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। আজকের আর্টিকেলে আমরা বিশেষায়িত ব্যাংক সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। বিশেষায়িত ব্যাংক সম্পর্কে যদি আপনাদের আর কোন মতামত থাকে তাহলে অবশ্যই আমাদের কমেন্টের মাধ্যমে জানাতে পারেন। এবং এরকম তথ্যবহুল আর্টিকেল পাওয়ার জন্য আমাদের ওয়েবসাইটের সাথেই থাকুন। সম্পূর্ণ পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।