প্রজেক্টর হলো একটি আউটপুট ডিভাইস যার দ্বারা ভিডিও বা ছবির আকারে ডাটা প্রদর্শন করে। এটি মূলত কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইল বা অন্য কোনো ডিভাইস থেকে পাওয়া তথ্যকে একটি বড় পর্দা বা দেয়ালে প্রোজেক্ট করে দেখায়।
সহজ ভাষায়, প্রজেক্টর হলো এমন একটি ডিভাইস যা ছোট স্ক্রিনের ছবি বা ভিডিওকে বড় স্ক্রিনে প্রদর্শন করে। প্রজেক্টর বিভিন্ন ধরণের হতে পারে, যেমন – LCD, DLP, LED প্রজেক্টর ইত্যাদি। প্রতিটি প্রজেক্টরের নির্দিষ্ট প্রযুক্তি এবং বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা এর কার্যক্ষমতাকে আলাদা করে।
এই আর্টিকেলটির মাধ্যমে আমরা জানবো প্রজেক্টর কি সে বিষয়ে বিস্তারিত? আরো জানবো প্রজেক্টর কিভাবে কাজ করে? অতঃপর শিখিয়ে দিবো প্রজেক্টর ব্যবহারের নিয়ম।
পোস্টের বিষয়বস্তু
প্রজেক্টর কি
প্রজেক্টরের বাংলা অর্থ হলো ‘প্রক্ষেপক’। এই শব্দটি এসেছে ইংরেজি শব্দ “Projector” থেকে, যার অর্থ হলো কোনো কিছু (যেমন – ছবি, ভিডিও) প্রক্ষেপণ বা প্রদর্শন করা।
Projector মূলত ছোট আকারের ভিডিও, ছবি, কিংবা ডাটা গ্রাফিক্সকে বড় আকারে প্রদর্শন করার জন্য ব্যবহৃত হয়, যেমন: স্ক্রিনে, দেওয়ালে, বা অন্য কোনো বড় সমতল স্থানে। প্রজেক্টর অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়, যেমন: শিক্ষাক্ষেত্র, অফিসে প্রেজেন্টেশন, সিনেমা হলে, বা বাড়িতে বিনোদনের জন্য।
প্রজেক্টরের আধুনিক রূপের পেছনে অবদান রয়েছে বিভিন্ন আবিষ্কারকের, তবে এর প্রাথমিক ধারণাটি গড়ে তোলেন থমাস এডিসন। কিন্তু প্রজেক্টরের আসল প্রতিষ্ঠা করেন একজন জার্মান প্রকৌশলী ইয়োহান জর্জ হানস। তিনি ১৮৪৫ সালে “জেন্ট্রিক ল্যান্টার্ন” নামে প্রথম অপটিক্যাল প্রজেক্টর তৈরি করেন।
পরে ১৮৯৫ সালে থমাস এডিসন এবং তার সহকারী উইলিয়াম ডিক্সন চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য ‘কিনেটোস্কোপ’ নামে একটি ডিভাইস তৈরি করেন, যা থেকে আধুনিক সিনেমা প্রজেক্টরের ধারণার ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়।
কেন প্রজেক্টর ব্যবহার করা হয়
প্রজেক্টর ব্যবহারের প্রধান উদ্দেশ্য হলো ছোট আকারের ছবি, ভিডিও বা ডাটা গ্রাফিক্সকে বড় পরিসরে প্রদর্শন করা। এবার প্রজেক্টর কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যবহার হয় সে বিষয়ে তথ্য তুলে ধরবো:
১) শিক্ষাক্ষেত্রে: প্রজেক্টর শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের জন্য ক্লাসরুমে একটি গুরুত্বপূর্ণ ডিভাইস। এর মাধ্যমে বড় স্ক্রিনে পাঠ্যবিষয় উপস্থাপন করা যায়, যা শিক্ষার্থীদের শেখার আগ্রহ বাড়ায় এবং বিষয় গুলো সহজে বোঝা যায়। অডিও-ভিজ্যুয়াল কন্টেন্ট প্রদর্শনের মাধ্যমে শিক্ষাদানের প্রক্রিয়াকে আরও ইন্টারেকটিভ এবং আকর্ষণীয় করা সম্ভব।
২) ব্যবসা ও প্রেজেন্টেশনে: বিভিন্ন অফিস মিটিং এবং প্রেজেন্টেশনের সময় প্রোজেক্টর ব্যবহার করা হয়। এটি বড় স্ক্রিনে ডেটা, গ্রাফ, চার্ট এবং রিপোর্ট প্রদর্শনের জন্য খুবই কার্যকর। একসাথে অনেক মানুষের সামনে তথ্য উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে প্রজেক্টর অত্যন্ত সুবিধাজনক।
৩) বিনোদনের জন্য: প্রজেক্টর মূলত সিনেমা, ভিডিও গেমস, এবং অন্যান্য বিনোদনমূলক কন্টেন্ট বড় স্ক্রিনে উপভোগ করার জন্য ব্যবহৃত হয়। বাড়িতে হোম থিয়েটার সিস্টেমের অংশ হিসেবে প্রজেক্টর অনেক জনপ্রিয়, কারণ এটি বড় পর্দায় সিনেমা দেখার মত অনুভুতি দেয়।
৪) কনফারেন্স ও ইভেন্টে: বিভিন্ন সেমিনার, কনফারেন্স এবং ইভেন্টে প্রোজেক্টরের ব্যবহার প্রচলিত। এটি বড় দর্শকগোষ্ঠীর সামনে প্রেজেন্টেশন, ভিডিও বা অন্যান্য কন্টেন্ট দেখানোর জন্য ব্যবহৃত হয়, যা একটি সফল উপস্থাপনার জন্য অত্যন্ত কার্যকর।
৫) ডাটা ভিজ্যুয়ালাইজেশনে: প্রজেক্টর বড় স্ক্রিনে ডাটা ভিজ্যুয়ালাইজেশন করার জন্য ব্যবহার করা হয়, যেমন – বিজ্ঞান গবেষণা, মেডিক্যাল ইমেজিং, বা ডিজাইনিংয়ের কাজে।
প্রজেক্টর কিভাবে কাজ করে
কখনো কি সিনেমা দেখতে গিয়ে ভেবেছেন, কীভাবে বিশাল পর্দার উপর সেই জীবন্ত ছবিগুলি ফুটে ওঠে? এর উত্তর হলো প্রজেক্টর। যদিও প্রজেক্টর সিনেমা হলে ব্যবহৃত হয়, তবে এর ব্যবহার শুধুমাত্র সেখানেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রজেক্টর কর্পোরেট মিটিং, ক্লাসরুম এবং নানা ধরনের সম্মেলনে ব্যবহৃত হয়।
বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের প্রজেক্টর তৈরি হয়েছে, তবে আমরা এখানে দুই ধরনের প্রজেক্টরের উপর ফোকাস করবো তা হলো: LCD এবং DLP প্রজেক্টর। প্রজেক্টর কীভাবে কাজ করে তা বোঝার জন্য আমাদের আলোচনার শুরুটা লাইট বিমের উৎপত্তি থেকে করতে হবে।
LCD প্রজেক্টর কিভাবে কাজ করে
LCD প্রজেক্টরের ক্ষেত্রে প্রথমে একটি শক্তিশালী সাদা আলো উৎপন্ন করা হয়। এই আলোর রশ্মি একগুচ্ছ আয়নায় প্রতিফলিত হয়, যেখানে দুটি ডাইক্রোইক আয়না থাকে। ডাইক্রোইক আয়নার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এগুলি শুধু এক ধরনের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো প্রতিফলিত করে। অর্থাৎ, সাদা আলো আয়নার উপর পড়ে এবং প্রতিটি আয়না শুধুমাত্র লাল, নীল বা সবুজ আলো প্রতিফলিত করে।
এরপর এই তিনটি আলোর রশ্মি একটি LCD স্ক্রিনের মধ্যে দিয়ে যায়। এই LCD স্ক্রিনে হাজার হাজার ক্ষুদ্র পিক্সেল থাকে। যখন এর মধ্যে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয় তখন আলোকে ব্লক করা বা আলোকে পাশ কাটানোর কাজ করা হয়।
প্রজেক্টরে তিনটি LCD স্ক্রিন থাকে, যা একই দৃশ্যকে গ্রেস্কেলে দেখায়। রঙিন আলো যখন এই তিনটি স্ক্রিনের মধ্যে দিয়ে যায়, তখন এটি একই দৃশ্যের তিনটি সংস্করণ তৈরি করে: একটি লাল, একটি সবুজ, এবং একটি নীল রঙের।
রঙের সংমিশ্রণ: সঠিক রঙ তৈরি করতে, এই তিনটি টিন্টেড ইমেজ ডাইক্রোইক ক্রিস্টালের মধ্যে দিয়ে যায়, যার ফলে অসংখ্য রঙের সমন্বয়ে তৈরি হয় একটি সম্পূর্ণ রঙিন দৃশ্য। প্রজেক্টরের লেন্স এই সকল রশ্মিকে একত্রিত করে এবং অবশেষে, আমরা পর্দায় সেই উজ্জ্বল এবং স্পষ্ট চিত্র দেখতে পাই।
DLP প্রজেক্টর কিভাবে কাজ করে
DLP প্রজেক্টর উন্নয়ন করা হয় ১৯৮০-এর দশকে। এটি মূলত ডিজিটাল মাইক্রোমিরর ডিভাইস (DMD) নামে একটি মাইক্রোচিপের উপর ভিত্তি করে কাজ করে। DMD হল একটি চিপ, যার মধ্যে প্রায় দুই মিলিয়ন ক্ষুদ্র আয়না একটি বর্গাকার গ্রিডের মধ্যে সাজানো থাকে।
প্রতিটি আয়না একটি পিক্সেলের সাথে যুক্ত থাকে এবং একটি ইলেকট্রনিক সার্কিট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, যা প্রতিটি আয়নার অভিমুখ নির্ধারণ করে। প্রথমে একটি উজ্জ্বল আলো DMD-এর দিকে চালিত হয় এবং ইলেকট্রনিক সার্কিট প্রতিটি আয়নাকে আলোর উৎসের দিকে বা এর বিপরীত দিকে ঝুঁকিয়ে দেয়।
যদি আয়নাটি আলোর উৎসের দিকে ঝুঁকে থাকে, তবে তা আলোকে পর্দার দিকে প্রতিফলিত করে। যদি না হয়, তবে সেই স্থানে কোনো আলো প্রতিফলিত হয় না। ফলে সেই অংশ অন্ধকার থাকে। এইভাবে লক্ষ লক্ষ আয়না একসাথে কাজ করে এবং একটি উচ্চ-রেজোলিউশনের দৃশ্য তৈরি করে।
রঙ যুক্ত করার প্রক্রিয়া: DLP প্রজেক্টরে রঙ যুক্ত করার জন্য একটি অতিরিক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, যেখানে একটি রঙের চাকা থাকে। চাকাটি লাল, নীল এবং সবুজ রঙের সমন্বয়ে গঠিত। এই রঙ যখন আয়নার উপর প্রতিফলিত হয় এবং একসঙ্গে মেশে, তখন অসংখ্য রঙ তৈরি হয়। এভাবেই DLP প্রজেক্টর হাই-ডেফিনিশন দৃশ্য তৈরি করে।
প্রজেক্টর ব্যবহারের নিয়ম
প্রজেক্টর কি, প্রজেক্টর কিভাবে কাজ করে সে বিষয়ে আমাদের জানা শেষ। এবার জাবো কিভাবে একটি প্রজেক্টর এবং ল্যাপটপ বা কম্পিউটারে সংযোগ দিবেন ও ডিসকানেক্ট করবেন। এই কাজটি করতে প্রথমে, প্রজেক্টর চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস রেডি রাখতে হবে। সেগুলো হলো:
- ল্যাপটপ
- প্রজেক্টর:
- পাওয়ার সোর্স
- ভিজিএ কেবল
- ইউএসবি ফ্ল্যাশ ড্রাইভ
- ওয়্যারলেস মাউস
প্রজেক্টর এবং ল্যাপটপ সংযোগ করার পদ্ধতি
১) প্রথমে একটি স্থান বেছে নিন যেখানে আপনি প্রজেক্টর এবং ল্যাপটপ রাখতে পারবেন। যেমন: একটি টেবিল।
২) যদি টেবিল থেকে পাওয়ার সোর্স অনেক দূরে থাকে, তাহলে আপনি একটি এক্সটেনশন কেবল ব্যবহার করতে পারেন। প্রজেক্টর এবং ল্যাপটপ উভয়কেই বিদ্যুৎ সংযোগে যুক্ত করতে হবে
৩) প্রজেক্টর এবং ল্যাপটপকে সংযুক্ত করার জন্য ভিজিএ কেবলের প্রয়োজন। ভিজিএ কেবলের দুটি প্রান্ত থাকে। একটি প্রজেক্টরে এবং অন্যটি ল্যাপটপে সংযুক্ত হবে।
৪) সবকিছু সংযোগ করার পরে, ল্যাপটপ চালু করুন। পাওয়ার বাটন প্রেস করার পর ল্যাপটপটি ওপেন হবে।
৫) এবার প্রজেক্টর চালু করুন। প্রজেক্টরের পাওয়ার বাটন চাপ দিলে এর রঙ কমলা থেকে সবুজ হয়ে যাবে, যা নির্দেশ করে যে প্রজেক্টর চালু হয়েছে। প্রজেক্টর এবং ল্যাপটপ উভয়ই চালু হলে তারা সংযোগ দিতে হবে।
প্রেজেন্টেশন দেখানোর পদ্ধতি
প্রেজেন্টেশন বা ভিডিও প্রদর্শনের জন্য ইউএসবি ফ্ল্যাশ ড্রাইভ ব্যবহার করা হয়। ফ্ল্যাশ ড্রাইভটি ল্যাপটপের ইউএসবি পোর্টে সংযুক্ত করুন। এটি সংযুক্ত হওয়ার পরে, “মাই কম্পিউটার” এ যান এবং ফ্ল্যাশ ড্রাইভটি সিলেক্ট করুন।
ফ্ল্যাশ ড্রাইভ থেকে প্রেজেন্টেশনের ফাইল সিলেক্ট করুন। উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি একটি PowerPoint ফাইল চালাতে চান, তাহলে ফাইলটি ডাবল ক্লিক করে খুলুন এবং ‘Slideshow’ মেনুতে যান। তারপর ‘From Beginning’ ক্লিক করে প্রেজেন্টেশন শুরু করুন।
যদি স্ক্রিনে প্রজেকশন অস্পষ্ট বা ঝাপসা মনে হয়, তাহলে প্রজেক্টরের লেন্স বা ফোকাস রিং ব্যবহার করে ছবির রেজোলিউশন বাড়িয়ে কমিয়ে নিন।
প্রেজেন্টেশন বন্ধ করা
প্রেজেন্টেশন শেষে, ‘End Show’ এ ক্লিক করে প্রেজেন্টেশন বন্ধ করুন। ফাইলটি বন্ধ করার জন্য স্ক্রিনের উপরের ডান কোণের লাল ‘X’ বাটনে ক্লিক করুন। অন্যদিকে, প্রোজেক্টরের পাওয়ার বাটনে আবার ক্লিক করে এটি বন্ধ করুন। এটি সবুজ থেকে কমলা রঙে পরিবর্তিত হবে, যা নির্দেশ করে যে প্রজেক্টর বন্ধ হয়েছে। প্রজেক্টরটি বন্ধ হলেও পাওয়ার কর্ড সরানোর প্রয়োজন নেই, কেননা এটি নিজেই সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যাবে।
আরো পড়ুন
প্রজেক্টর সম্পর্কে আমাদের মতামত
তাহলে বুঝে গেলেন প্রজেক্টর কি, জেনে গেলেন প্রজেক্টর কিভাবে কাজ করে এবং শিখে গেলেন প্রজেক্টর ব্যবহারের নিয়ম। আশা করছি আর্টিকেলটি পড়ার পর সঠিক ভাবে প্রোজেক্টর ব্যবহার করতে পারবেন। এমনই জটিল বিষয় গুলোকে সহজে বুজতে অনুসরণ করুন আমাদের ওয়েবসাইটটি, ধন্যবাদ।