অনেকেই উপনদী ও শাখা নদীর পার্থক্য সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানেন না। উপনদী এবং শাখা নদীর মধ্যে রয়েছে ব্যাপক পার্থক্য। কোন নদী যখন একটি উৎস থেকে উৎপত্তি লাভ করে কিছুটা অতিক্রান্ত হওয়ার পর অন্য নদীতে পতিত হয় তাকে উপনদী বলা হয়ে থাকে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, যে নদী অন্য নদীতে পতিত হয় তাকে উপনদী বলে। অন্যদিকে শাখা নদী বলতে যে নদী অন্য নদী থেকে উৎপন্ন হয়েছে তাকে বলে।
বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে এমন প্রচুর উপনদী রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য উপনদী গুলো হলো: তিস্তা, ধরলা করতোয়া ইত্যাদি।
অন্যদিকে বাংলাদেশের উপর দিয়ে যেসব শাখা নদী গুলো প্রবাহিত হচ্ছে সেগুলো হল: মধুমতী, মাথাভাঙ্গা, কপোতাক্ষ নদ, পশুর নদ, বেতনা নদী ইত্যাদি পদ্মা নদীর বেশ কিছু শাখা নদী। আমাদের সম্পূর্ণ আর্টিকেল জুড়ে আমরা উপনদী ও শাখা নদীর পার্থক্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
পোস্টের বিষয়বস্তু
উপনদী কি
যখন একটি ছোট নদী অন্য একটি বড় নদীর সাথে মিলিত হয় তখন তাকে উপনদী বলা হয়ে থাকে। যেকোনো বড় নদীকে যদি মায়ের সাথে তুলনা করা হয় তাহলে উপনদী গুলোকে তার সন্তানের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়: বাংলাদেশের প্রবাহিত যমুনা নদী হল গঙ্গা নদীর উপনদী। এবং লোহিত নদী হলো ব্রহ্মপুত্র নদের উপনদী। বিভিন্ন অঞ্চলের জন্য উপনদী পানির একটি ভালো উৎস হিসেবে কাজ করে।
এছাড়া জীব বৈচিত্র সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এবং পরিবহন ব্যবস্থার জন্য ও উপনদীর ভূমিকা মুখ্য। উপনদীর ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Tributary। একটি বৃহৎ নদীর সাথে একবার একাধিক উপনদী যুক্ত হতে পারে। কারণ উপনদী হলো একটি জল-বিভাজিকার প্রকরণ। বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য উপনদী গুলো হল: তিস্তা, ধরলা, করতোয়া, আত্রাই, সুবর্ণশ্রী ইত্যাদি।
উপনদীর উদাহরণ
- আমাজন নদীর উপনদী গুলো হলো: জুরুয়া, পুরুস, জিঙ্গু, মাদিরা ইত্যাদি।
- গঙ্গা নদীর উপনদী গুলো হল: রামগঙ্গা, গোমতী, ঘর্ঘরা, গন্ডক, কোশী ইত্যাদি।
- সিন্ধু নদের উপনদী গুলো হলো: শতদ্রু, বিপাশা, চন্দ্রভাগা, বিতস্তা ইত্যাদি।
উপনদীর বৈশিষ্ট্য
উপনদীর বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। নিচে উপনদীর বৈশিষ্ট্য গুলো তুলে ধরা হলো:
প্রবাহের গতিবিধি
উপনদী গুলোর পানি প্রবাহের ক্ষমতা সাধারণত মূল নদীগুলো থেকে কম হয়ে থাকে। এবং উপনদী গুলোর বিস্তীর্ণতা মূল নদীর বিস্তীর্ণতা থেকে তুলনামূলক কম।
ক্ষয়প্রাপ্তি
সময়ের সাথে সাথে উপনদী গুলো ক্রমান্বয়ে দুর্বল হতে থাকে। এর প্রধান কারণ হলো কিছুকাল পরে ক্ষয় পেয়ে উচ্চভূমি এর ঢাল কমে যায়। এতে করে উপনদী গুলো ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকে।
উৎপত্তিস্থল
উপনদীর উৎপত্তিস্থল গুলো সাধারণত উচ্চভূমি, পাহাড়-পর্বত, মালভূমি থেকে হয়। উচ্চভূমি, পাহাড়, পর্বত, মালভূমি থেকে সৃষ্ট জলধারা কেই সাধারণত উপনদী বলা হয়ে থাকে।
পানি প্রবাহ
উপনদী গুলো তুলনামূলকভাবে মূল নদীর চেয়ে আকারে ছোট হয়। কিন্তু উপনদী গুলো খুবই খরস্রোতা প্রকৃতির হয়ে থাকে। অধিক পরিমাণে খরস্রোতা হলেও এই নদীগুলো সাধারণত মূল নদীর তুলনায় কম শক্তিশালী হয়।
জীববৈচিত্র্য
প্রধান নদীর মত উপনদী গুলোতেও প্রচুর পরিমাণে জীব বৈচিত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। জলজ উদ্ভিদ, জলজ পোকামাকড়, মাছ টিকে থাকার আশ্রয়স্থল হিসেবে উপনদী উল্লেখযোগ্য।
নদীর আকার
উপনদীর আকার সাধারণত সংকীর্ণ ধরনের হয়ে থাকে। অর্থাৎ এর আকার সর্বদা প্রধান নদীর তুলনায় ছোট হবে।
শাখানদী কি
যে সকল নদী প্রাকৃতিকভাবে ঝরণাধারা, হ্রদ, বরফগলিত স্রোত থেকে উৎপন্ন হয় না, কিন্তু অন্য একটি বড় নদী থেকে উৎপন্ন হয় তাকে শাখা নদী বলা হয়ে থাকে। যেকোনো বড় নদীর মধ্যভাগ থেকে সাধারণত শাখা নদীর উৎপত্তি হয়। যখন একটি বড় নদীর পানির পরিমাণ বৃদ্ধি পায় তখন নদীটি অন্যদিকে বাঁক নিতে পারে। এরূপ অবস্থায় একটি শাখা নদী তৈরি হয়।
উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে: বাংলাদেশের বুড়িগঙ্গা নদী ধলেশ্বরী নদীর শাখা নদী। শাখা নদী গুলোতে পানির পরিমাণ নির্ভর করে মূল নদীর পানির উপরে। মূল নদীগুলোতে পানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে শাখা নদীর ও পানির পরিমান বেড়ে যায়। বাংলাদেশের পদ্মা নদীর বেশ কিছু শাখা নদী রয়েছে। এগুলো হলো: মধুমতী, মাথাভাঙ্গা, কপোতাক্ষ নদ, পশুর নদ, বেতনা নদী ইত্যাদি।
শাখা নদীর উদাহরণ
- নীল নদের উল্লেখযোগ্য শাখা নদী হল ডামিয়েত্তা ও রোসে।
শাখা নদীর বৈশিষ্ট্য
উপনদীর মতো শাখা নদীর ও নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। নিচের শাখা নদীর বৈশিষ্ট্যসমূহ তুলে ধরা হলো:
আকারে তুলনামূলক ছোট
যেহেতু বড় কোন নদীর থেকে শাখা নদীর সৃষ্টি হয় তাই প্রাকৃতিকভাবেই শাখা নদীর আয়তন তুলনামূলক মূল নদীর থেকে কম হয়। শাখা নদী কোনভাবেই মূল নদীর থেকে আয়তনে বড় হতে পারে না।
পানির উৎস
শাখা নদীর পানির উৎস মূল নদী ছাড়াও অনেক সময় হিমবাহ গলিত পানি, বৃষ্টিপাত থেকে তৈরি হয়। হিমবাহ গলিত পানি এবং বৃষ্টির পানি দুটোই শাখা নদীর পানি বৃদ্ধির কারণ।
মূল নদী থেকে উৎপত্তি
শাখা নদীর উৎপত্তি সাধারণত একটি বড় নদী থেকেই হয়। যেসব নদী কোন বড় নদী থেকে উৎপন্ন না হয়ে ঝরণাধারা, হ্রদ, বরফগলিত স্রোত থেকে উৎপন্ন হয়েছে তাকে শাখা নদী বলা যায় না।
গতিবেগ তুলনামূলক কম
যেকোনো শাখা নদী তৈরি হওয়ার পর মূল নদীর স্রোতের পরিমাণ অনেকটা কমে আসে। অর্থাৎ শাখা নদী মূল নদীর স্রোতের গতিবেগ কমিয়ে দেয়।
মোহনা
শাখা নদীর মোহনা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মূল নদীর মোহনার অন্তর্গত হয়ে থাকে। অর্থাৎ শাখা নদী ও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাগর, মহাসাগর বা হ্রদ এ পতিত হওয়ার জন্য প্রবাহিত হয়।
বিচ্ছিন্নতা
শাখা নদীর ও মূল নদীর সাথে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মূল নদী যদি কোন কারণে দিক পরিবর্তন করে তাহলে অনেক সময় শাখা নদী থেকে মূল নদী বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
আরো পড়ুন
স্বতন্ত্র জলধারা
মূল নদী থেকে শাখা নদী তৈরি হলেও শাখা নদী এবং মূল নদীর জলধারা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র হয়ে থাকে। অর্থাৎ এরা স্বতন্ত্র জলধারা অনুযায়ী প্রবাহিত হয়।
উপনদী ও শাখা নদীর পার্থক্য
নিচে একটি ছকের সাহায্য উপনদী ও শাখা নদীর পার্থক্য গুলো তুলে ধরা হলো:
বৈশিষ্ট্য | উপনদী | শাখা নদী |
সংজ্ঞা | যখন একটি বড় নদীতে ছোট নদী এসে মিলিত হয় তখন তাকে উপনদী বলে। | যদি একটি বড় নদী থেকে কোন ছোট নদী বের হয় তখন তাকে শাখা নদী বলে। |
উৎপত্তিস্থল | উপনদীর উৎপত্তিস্থল সর্বদা পাহাড় বা উঁচু জায়গা থেকে হয়ে থাকে। | শাখা নদী সাধারণত একটি বড় নদী থেকে উৎপন্ন হয়। শাখা নদী একটি প্রধান নদী থেকে উৎপন্ন হয়ে নতুন পথে প্রবাহিত হয়। |
পানি প্রবাহ | উপনদীর পানি প্রবাহ সর্বদা প্রধান নদীর দিকে হয়ে থাকে। | শাখা নদীর পানিপ্রবাহ একটি নির্দিষ্ট দিকে বিরাজমান নয়। শাখা নদী থেকে পানি বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। |
মিলন | উপনদী কখনোই সাগর বা সমুদ্রে মিলিত হয় না। | শাখা নদী কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাগর বা সমুদ্রে মিলিত হয় আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয় না। |
উদাহরণ | যমুনা নদীর কিছু উপনদীর উদাহরণ হল: তিস্তা, ধরলা, করতোয়া। | যমুনা নদীর শাখা নদী হল ধলেশ্বরী। পদ্মা নদীর শাখা নদী হল মাথাভাঙ্গা এবং মধুমতি। |
যেকোনো ধরনের নদী (প্রধান নদী, শাখা নদী, উপনদী) তিনটি জনজীবন এর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে, জীব বৈচিত্র্য রক্ষায়, জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করতে, কৃষি কাজের জন্য যেকোনো নদীর ভূমিকায় মুখ্য।
উপনদী ও শাখা নদী সম্পর্কিত কিছু প্রশ্নউত্তর
উপনদী শব্দের সমার্থক শব্দ কোনটি?
উপনদী শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো ট্রিবিউটারি। এই ইংরেজি শব্দটি ল্যাটিন শব্দ ট্রিবিউটাম থেকে উৎপন্ন হয়েছে। ট্রিবিউটাম শব্দের অর্থ হলো “একটি জিনিস, অবদান বা প্রদত্ত”।
উপনদী সমার্থক শব্দ?
উপনদী শব্দের সমার্থক শব্দ হল একটি স্রোত একটি বড় স্রোত বা একটি হ্রদ।
উপনদী কি নদীতে প্রবাহিত হয়?
উপনদী প্রধান নদীর দিকে প্রবাহিত হয়, কিন্তু উপনদী কোনভাবেই সাগর-মহাসাগরের দিকে প্রবাহিত হয় না।
উপনদী ও শাখা নদী নিয়ে আমাদের মতামত
আজকের এই সম্পূর্ণ আর্টিকেল জুড়ে আমরা উপনদী কি, শাখা নদী কি, উপনদীর, উদাহরণ শাখা নদীর উদাহরণ, উপনদীর বৈশিষ্ট্য, শাখা নদীর বৈশিষ্ট্য উপনদী ও শাখা নদীর পার্থক্য ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। উপনদী ও শাখা নদী সম্পর্কিত আজকের এই আর্টিকেলকে যদি আপনাদের ভালো লেগে থাকে তাহলে আমাদের ওয়েবসাইটের সাথেই থাকুন।
উপনদী ও শাখা নদী সম্পর্কে আপনাদের আর কোন প্রশ্ন থাকলে আমাদেরকে অবশ্যই কমেন্টের মাধ্যমে জানান। এবং সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এমন আরো গুরুত্বপূর্ণ আর্টিকেল পড়তে আমাদের ওয়েবসাইটটি ভিজিট করুন।