জলবায়ুর উপাদান গুলো কি কি এ সম্পর্কে সঠিক তথ্য আমাদের অনেকেরই অজানা। সাধারণত বেশ কিছুদিন ধরে আবহাওয়ার কয়েকটি উপাদান বিশ্লেষণ করে জলবায়ু সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। কোন একটি নির্দিষ্ট স্থানের বায়ুর তাপমাত্রা, বৃষ্টি পাত, বায়ুপ্রবাহ, বায়ুর চাপ, আর্দ্রতা, তুষারপাত, মেঘাচ্ছন্নতা পর্যবেক্ষণ করলে যে সামগ্রিক রূপ ফুটে ওঠে তাকে সে স্থানের জলবায়ু বলা যেতে পারে। বর্তমানে বিভিন্ন কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিবেশ এবং প্রকৃতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যে কোন স্থানে জলবায়ু হঠাৎ করে পরিবর্তন হয় না বরং ব্যাপক সময়ের ব্যবধান একটি স্থানে জলবায়ু পরিবর্তন হয়ে থাকে। প্রতিটি অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা, কৃষিকাজ, মানুষের সর্বাঙ্গীণ স্বাস্থ্য, উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও প্রকৃতি, অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পূর্ণভাবে সেই অঞ্চলের জলবায়ুর ওপর নির্ভরশীল। নিচে আমরা জলবায়ুর উপাদান গুলো কি কি সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
পোস্টের বিষয়বস্তু
জলবায়ূ কাকে বলে
কোন নির্দিষ্ট স্থানের অন্তত ৩০-৩৫ বছরের আবহাওয়ার সামগ্রিক অবস্থার হিসাব কে জলবায়ু বলা হয়ে থাকে। জলবায়ুর পরিবর্তন সাধারনত আবহাওয়ার ঘনঘন পরিবর্তন এর উপর নির্ভরশীল। কোন নির্দিষ্ট স্থানের আবহাওয়ার ঘনঘন পরিবর্তনের ফলে সেই স্থানের বৃহৎ এলাকা জুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন হয়ে থাকে। সাধারণত আবহাওয়ার কিছু পরিবর্তন যেমন: তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত এবং আদ্রতা পরিবর্তন এর ফলে জলবায়ু ও পরিবর্তন হতে থাকে। বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন একটি ধীর এবং চলমান প্রক্রিয়া যা মোটামুটি উষ্ণ, আদ্র এবং সমভাবাপন্ন। বাংলাদেশের এই ধীর এবং চলমান জলবায়ু কে ‘ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ু’ হিসেবে ও চিহ্নিত করা হয়।
জলবায়ুর উপাদান গুলো কি কি
আবহাওয়ার বিভিন্ন উপাদান যেমন: বায়ুর তাপ, চাপ, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত এর মত জলবায়ুর উপাদানগুলো ও একই। বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা বলতে বোঝানো হয় বায়ুর উষ্ণতম বা শীতলতম অবস্থাকে। বায়ুমন্ডলের এই তাপমাত্রা পরিবর্তনের সাথে জলবায়ু পরিবর্তন নির্ভরশীল। আবহাওয়া এবং জলবায়ু গড়ে ওঠার পেছনে কয়েকটি উপাদান প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। জলবায়ুর প্রধান দুইটি উপাদান বৃষ্টিপাত এবং তাপমাত্রা হলেও এর আরো কিছু উপাদান রয়েছে। সেগুলো হলো:
- তাপমাত্রা,
- বায়ুর চাপ,
- বায়ু প্রবাহ,
- বায়ুর আদ্রতা ও শুষ্কতা,
- বৃষ্টিপাত।
চলুন নিচে জলবায়ুর উপাদান গুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা যাক:
১) তাপমাত্রা
তাপমাত্রা জলবায়ুর একটি মূল উপাদান। মূলত সূর্যের আলো পৃথিবীতে উষ্ণ করতে সাহায্য করে। তাই সূর্যের তাপের ভিন্নতার উপর এক এক স্থানের তাপমাত্রা একেক রকম হয়ে থাকে। তাপমাত্রা পরিমাপের জন্য থার্মোমিটার ব্যবহার করা হয়, যা সাধারণত সেলসিয়াস এবং ফারেনহাইট স্কেলে দেখায়। তাপমাত্রা জীবজগতের বৃদ্ধি, প্রজনন এবং বেঁচে থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও তাপমাত্রা পরিবর্তন হওয়ার সাথে সাথে বৃষ্টিপাত, বায়ু প্রবাহ এবং আবহাওয়ার অন্যান্য উপাদান পরিবর্তন হতে থাকে।
গ্রীন হাউজ গ্যাসের নিঃসরণ, বন ধ্বংস ছাড়াও আরো বিভিন্ন কারণে তাপমাত্রা প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। যে স্থানে তাপমাত্রা বেশি সেই স্থানের মানুষ উষ্ণতম জলবায়ু উপভোগ করে এবং তাপমাত্রা কম থাকলেও নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু উপভোগ করে। তাপমাত্রা মাপার এককগুলো হলো: সেলসিয়াস, ফারেনহাইট এবং কেলভিন। তবে দৈনন্দিন জীবনে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা মাপার একক হিসেবে সেলসিয়াস ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বৈজ্ঞানিক কাজে তাপমাত্রা মাপার একক হিসেবে কেলভিন ব্যবহৃত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ আরো কয়েকটি দেশে তাপমাত্রা মাপার যন্ত্র হিসেবে ফারেনহাইট একক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
২) বায়ুচাপ
বায়ুচাপ বলতে বোঝায় কোন নির্দিষ্ট স্থানের বায়ুর ওজনের চাপ। জলবায়ুর এই উপাদান মিলিবাল বা হেক্টোপাস্কাল এককে মাপা হয়ে থাকে। বায়ুর চাপে তারতম্য দেখা দেওয়ার প্রধান কারণ হলো পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে সূর্যের তাপের প্রভাবে বায়ুর উষ্ণতা এবং ঘনত্বের তারতম্য সৃষ্টি হওয়া। বায়ুচাপের পরিবর্তন সরাসরি আবহাওয়াকে প্রভাবিত করে। বায়ুর চাপ সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে:
- উচ্চচাপ,
- নিম্নচাপ।
সাধারণত যেখানে বায়ুর ঘনত্ব বেশি এবং তাপমাত্রা কম সেখানে উচ্চচাপ সৃষ্টি হয়। এবং যেখানে বায়ুর ঘনত্ব কম আর তাপমাত্রা বেশি সেখানে নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়। প্রতিনিয়ত বায়ু চাপের পরিবর্তনের জন্য বিভিন্ন স্থানে জলবায়ুর মধ্যে পরিবর্তন দেখা দেয়। বিভিন্ন প্রকার জলবায়ুর বলয় সৃষ্টি হওয়ার জন্য বায়ু চাপের এই পরিবর্তন ই দায়ী। পৃথিবীতে তৈরি হওয়া বিভিন্ন প্রকার জলবায়ু বলয় গুলো হল: নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয়, আন্তঃক্রান্তিয় অভিসরণ এলাকা ইত্যাদি।
৩) বায়ু প্রবাহ
জলবায়ুকে প্রভাবিত করে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল বায়ু প্রবাহ। বায়ু প্রতিনিয়ত থেকে অন্য স্থানে সঞ্চালিত হতে থাকে। বায়ুর এই প্রতিনিয়ত সঞ্চালনের ফলে তাপমাত্রা, আদ্রতা এবং বৃষ্টিপাতের পরিমাণ পরিবর্তিত হতে থাকে। এক এক স্থানের তাপমাত্রা এক এক রকম হওয়ার কারণে বায়ু উষ্ণ অঞ্চল থেকে শীতল অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয়। তবে ভূমির বিভিন্ন আকার যেমন: পাহাড়, উপত্যকা এবং সমুদ্রের উপস্থিতির কারণে বায়ুপ্রবাহের দিক পরিবর্তন হতে থাকে।
বায়ুর গতি সম্পূর্ণভাবে আবহাওয়া এবং জলবায়ুর উপর প্রভাব বিস্তার করে। সমুদ্র থেকে তৈরি হওয়া জলীয়বাষ্প পুরনো বায়ু যদি কোন একটি অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয় তাহলে সে স্থানে বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি পাবে এবং তাপমাত্রা কমতে থাকবে। কিন্তু যদি এই বায়ু চাপ স্থলভাগ থেকে আগত হয় তাহলে তাপ প্রবাহ হ্রাস পায় না। যদি কোন স্থানের বায়ু শুষ্ক থাকে তাহলেও সে স্থানে বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না এবং ঐ স্থানে তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ থেকে সহজেই বোঝা যাচ্ছে, জলবায়ু সরাসরি প্রভাবিত করতে বায়ুপ্রবাহ এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
৪) বায়ুর আর্দ্রতা ও শুষ্কতা
জলবায়ুকে প্রভাবিত করে এমন অনেক উপাদানের মধ্যে বায়ুর আর্দ্রতা ও শুষ্কতা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বায়ুর আদ্রতা এবং শুষ্কতা পরিবেশের তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত এবং সামগ্রিক জীবন যাপন এর ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। বায়ুর আদ্রতা বলতে বোঝায় বায়ুমন্ডলের বাষ্প রূপে উপস্থিত হওয়া পানি। বায়ুর আদ্রতার মাধ্যমে সহজে বাতাসে কতটুকু জলীয় বাষ্প রয়েছে তা বোঝা যায়। বায়ুর আদ্রতা বেশি হলে জলীয় বাষ্প ধারণ ক্ষমতা ও বৃদ্ধি পায়। বাতাসে আর্দ্রতা বেশি থাকলে বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি থাকে, যার ফলে বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
অন্যদিকে বাতাসে যখন জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কম থাকে তখন তাকে বায়ুর শুষ্কতা বলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাতাসের এই শুষ্ক ভাব গ্রীষ্মকালে এবং মরুভূমিতে পরিলক্ষিত হয়। বাতাসে শুষ্কতা বেশি থাকলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যায় ফলে অনেক অঞ্চলে খরা দেখা দিতে পারে। বায়ুর আর্দ্রতা এবং শুষ্কতা এই দুটি উপাদান ই জীবজগত, কৃষি, শিল্প এবং দৈনন্দিন জীবনকে বিভিন্ন ভাবে প্রভাবিত করে থাকে।
৫) বৃষ্টিপাত
জলবায়ুর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো বৃষ্টিপাত। পৃথিবীতে পানির একটি বড় উৎস হল বৃষ্টিপাত। পরিবেশ সতেজ রাখা এবং ফসল উৎপাদনের জন্য বৃষ্টিপাত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জীব জগতের প্রয়োজন ছাড়াও জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বৃষ্টিপাত প্রয়োজন। যদি কোন স্থানে বৃষ্টিপাত পর্যন্ত পরিমাণে হয় তাহলে ধরে নেওয়া হয় সেখানকার জলবায়ু আদ্র। আর যদি কোন স্থানে বৃষ্টিপাত কম হয় তাহলে সেখানকার জলবায়ু শুষ্ক বলে ধরে নেওয়া হয়। তাই বোঝা যাচ্ছে, জলবায়ুর তারতম্য অনেকটা নির্ভর করে বৃষ্টিপাতের তারতম্য এর।
আরো পড়ুন
অনাবৃষ্টি যেমন পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে ঠিক তেমনি অতিবৃষ্টি ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক। অতি বৃষ্টির ফলে ফসল উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটার পাশাপাশি পরিবেশ এবং অর্থনীতির জন্য ও মারাত্মক ক্ষতিকর। অধিক বৃষ্টির ফলে অর্থনীতির কৃষি এবং শিল্প বিভাগ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
জলবায়ুর উপাদান সম্পর্কিত কিছু প্রশ্নউত্তর
কোন দেশের কত বছরের গড় আবহাওয়াকে জলবায়ু বলে?
একটি দেশের বা কোন একটি নির্দিষ্ট স্থানের অন্তত ৩০ থেকে ৩৫ বছরের আবহাওয়ার সামগ্রিক অবস্থাকে জলবায়ু বলা হয়ে থাকে।
বায়ু প্রবাহ কি জলবায়ুর উপাদান?
বায়ু প্রবাহ জলবায়ুর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বায়ুপ্রবাহ ছাড়াও বায়ুর তাপ ,বায়ুর চাপ ,বায়ুর আর্দ্রতা, বারিপাত বা অধঃক্ষেপ জলবায়ুর উপাদান। জলবায়ুর এই প্রত্যেকটি উপাদান নিয়ন্ত্রণ করে সমুদ্রস্রোত , অক্ষাংশ , বৃষ্টিপাত, উচ্চতা, পর্বতের অবস্থান ইত্যাদি।
জলবায়ু ও আবহাওয়া বলতে কি বুঝায়?
আবহাওয়া বলতে বোঝায় বায়ুমণ্ডলীয় স্বল্পমেয়াদি অবস্থা। এবং জলবায়ু বলতে বোঝায় একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের দীর্ঘমেয়াদি আবহাওয়ার গড় অবস্থাকে। আবহাওয়া খুব দ্রুত পরিবর্তন হলেও জলবায়ু পরিবর্তন একটি ধীর প্রক্রিয়া।
আবহাওয়া ও জলবায়ুর উপাদান কোনটি?
আবহাওয়া এবং জলবায়ুর প্রধান ছয়টি উপাদান হলো: তাপমাত্রা, বায়ুমণ্ডলীয় চাপ, বায়ু, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত এবং মেঘাচ্ছন্নতা। বাতাসে উপস্থিত জলীয় বাষ্পের ঘনত্ব বাতাসের আদ্রতা হিসেবে পরিচিত। আবহাওয়া এবং জলবায়ুর প্রত্যেকটি উপাদান পরিমাপ যোগ্য।
জলবায়ুর উপাদান সম্পর্কে আমাদের মতামত
প্রিয় পাঠক বৃন্দ, আশা করি আমাদের আজকের আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ে জলবায়ুর উপাদান গুলো কি কি এ সম্পর্কে আপনারা বিস্তারিত তথ্য পেয়েছেন। বাংলাদেশের জলবায়ু দিন দিন অধিক মাত্রায় ঝুঁকি তে পতিত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনে যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। জলবায়ু পরিবর্তনের এ বিশাল সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে জনসাধারণের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা থাকা জরুরী। পরিবেশ সংরক্ষণ করে, অধিক মাত্রায় বৃক্ষরোপণ করে, পরিবেশ দূষণ কমিয়ে আমরাও পারি জলবায়ু পরিবর্তনের এই হার কমিয়ে আনতে। আমাদের আর্টিকেলটি করে ভালো লাগলে অবশ্যই আমাদের ওয়েবসাইটের সাথেই থাকুন।
মহাসাগর সম্পর্কে আপনাদের আর কোন প্রশ্ন থাকলে আমাদেরকে অবশ্যই কমেন্টের মাধ্যমে জানান। এবং সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এমন আরো গুরুত্বপূর্ণ আর্টিকেল পড়তে আমাদের ওয়েবসাইটটি ভিজিট করুন।